দিনলিপি লিখতে ভালো লাগে না। কারণ অনেক সময় নষ্ট হয়। তাই লিখি না। গত দুই একদিন বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে মানুষের কষ্ট ও মারা যাওয়া দেখে নিজের খুব খারাপ লাগছে। আর তার সঙ্গে যোগ হয়েছে এই মুহূর্তে সব চেয়ে প্রয়োজনীয় করোনা ভাইরাস পরীক্ষণ কীট নিয়ে সরকারি মহলের টালবাহানা। তাই বাধ্য হয়ে লিখলাম।. সময় নিয়ে লিখলে হয়তো আরও ভালো লিখতে পারতাম।
আফসোস ‘ডক্টর বিজন কুমার শীল’ জন্মেছেন বাংলাদেশে। অন্য কোন দেশে হলে এই গুণীর কদর হতো। মাঝে মধ্যে বলতে ইচ্ছে হয় তিনি কেন সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো কোম্পানি বাদ দিয়ে জাফর উল্লাহ চৌধুরীর গণ স্বাস্থ্যে যোগ দিলেন। এই ভুল না করলে এতদিনে হয়তো তার একটা রাজকীয় সংবর্ধনার ব্যবস্থা হয়ে যেত। আমাকে একটা উদাহরণ দিন যেখানে বাংলাদেশে ভিন্ন মতের মানুষকে তার অবদানের জন্য সম্মানিত করা হয়েছে। জানি পারবেন না। আমি বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে ভয় পাই। যাই হোক রাজনীতি বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি।
ডক্টর বিজন কুমার শীল, বাংলাদেশের একজন বিজ্ঞানী। তিনি মাত্র ৩’শ টাকায় করোনা ভাইরাস পরীক্ষা করার কীট বা যন্ত্র পাতি আবিষ্কার করেছেন। গুগলে সার্চ করে দেখলাম, যুক্তরাজ্যে এই কীটের দাম কমপক্ষে ১ শ ১৯ পাউন্ড। ২০০৩ সালে যখন সার্স ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল তখন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল সিঙ্গাপুর গবেষণাগারে কয়েকজন সহকারীকে নিয়ে সার্স ভাইরাস দ্রুত নির্ণয়ের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
অন্যদিকে ডক্টর সারাহ গিলবার্ট, যুক্তরাজ্যের একজন বিজ্ঞানী. তিনি করোনা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কার করেছেন। তিনি ও একজন মেধাবী বিজ্ঞানী. সারাহ গিলবার্ট আরও ভ্যাকসিন আবিষ্কারে গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা রাখেন । দুই জনেরই তাদের প্রডাক্ট বাজারজাত করতে কয়েকটি ধাপ পার হতে হবে। দেখা যাক কোন সরকার কতটুকু সাহায্য করছে।
ড. বিজন কুমার শীল সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুকাল শিক্ষকতা করেন। এরপর ঐ চাকরি ছেড়ে জয়েন করেন এমপি নামক একটা বায়োলজিকস আমেরিকান কোম্পানিতে, ওটার মালিক ছিলেন যুগোস্লাভিয়ার একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। এরপর নিজেই বায়োলজিক্যাল রিয়েজেন্ট তৈরি ও ব্যবসা শুরু করেন। সম্প্রতি তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগ দেন মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টে। সেখানে তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি মনোযোগ দেন গবেষনায়। আমার কাছে আমার এক বন্ধু ব্যারিস্টার ফৌজিয়া আখতার একটা লিখা পাঠিয়েছেন। লেখাটি লিখেছেন সুইডেন থেকে ডাঃ মোঃ সাজেদুর রহমান শাওন। তিনি বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস কীট বাজারজাত করণের কয়েকটি ধাপ উল্লেখ করেছেন। ধাপ গুলো হলো।
১. তারা এই কিটটির কার্যকারিতা কিভাবে পরীক্ষা করা যায় সেটি নিয়ে একটি প্রটোকল লিখবেন এবং সেটি নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিবেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল
২. সেই প্রটোকলটি আপ্রুভড হলে তারা বা থার্ড পার্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিটটির কার্যকারিতা নিয়ে একটি এপিডেমিওলজিকাল গবেষণা করবে।
৩. আপনি আপনার গবেষণার সকল তথ্য উপাত্ত নিয়ে ডাইরেক্টর জেনারেল অব ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশনের কাছে জমা দিবেন
৪. তারা সকল তথ্য উপাত্ত যাচাই বাছাই করে আপনাকে পারমিশন দিবে সেই কিটটি উৎপাদন এবং বাজারজাত করার।
এবার দেখা যাক যুক্তরাজ্যে টিকা বাজার জাত করণের কয়টি ধাপ ও কি কি ?
(১) প্রথমে টিকাটি প্রাণীর মধ্যে পরীক্ষা করা হবে (২) তারপর সেটি মানুষের মধ্যে পরীক্ষা করা হবে। মানুষের মধ্যে বার কয়েক ধাপে কয়েক হাজার মানুষের মধ্যে পরীক্ষা করা হবে। এটা আবার মানুষের বিভিন্ন বয়স গ্রূপে আলাদা আলাদা করতে হবে। (৩) এক্সপার্ট টিকাটি রিভিউ করবে। যুক্তরাজ্যে যেটা হচ্ছে মেডিসিন এন্ড হেলথ কেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি এজেন্সী। তারপর শর্ত সাপেক্ষে ভ্যাকসিন বাজারজাত করার অনুমতি দিতে পারে। পুরো প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে ২ থেকে ৩ বছর লাগতে পারে।
আপনি যদি দুইটি করণীয় তালিকা দেখেন, তাহলে সহজেই অনুমান করতে পারবেন. বাংলাদেশের যে কার্যতালিকা সেগুলি সহজেই করা যায়। আমারতো মনে হয় দু’এক দিনেই সম্ভব। আর ব্রিটেনে প্রফেসর সারাহ গিলবার্টের এই টিকা লাইসেন্স পেতে কয়েক বছর লাগবে। অথচ কয়েকটি ধাপ এক সংগে সমান্তরাল ভাবে করে তা সেপটেমবরের মধ্যে শেষ করতে চায়। ব্রিটেনে সরকার ইতোমধ্যে এই টিকা আবিষ্কারের জন্য ইতিমধ্যে ২২ মিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্ধ করেছে। বলেছে টিকা কার্যকর হোক বা না হোক তারা এক মিলিয়ন ডোজ বানিয়ে মানসিক ভাবে প্রস্তুত। সরকার করোনা ভাইরাস করোনা ভাইরাস দ্রুত উৎপাদন ও বাজারজাত করার জন্য এটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে।
সরকারের মন্ত্রী অলোক শর্মা বলেছেন ভ্যাকসিন টি যাতে সফল হয় তার জনিত সরকারের সকল সহযোগিতা থাকবে। সরকারের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এই টাস্ক ফোর্সের প্রধান। সরকার শুধুমাত্র প্রফেসর সারাহ গিলবার্ট নয়। টিকা নিয়ে আবিষ্কার করছে এই রকম ২১ টি অর্থ সহায়তা করছে। আর বাংলাদেশে শুধুমাত্র একটি সংস্থা কাজ করছে আর সরকার তাকে নিয়ম কানুন দেখিয়ে একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যে সরকারি নার্সদের একটি সংগঠন ডক্টর জাফর উল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলার হুমকি দিয়েছে।
সাংবাদিক গোলাম মোর্তজার এর তথ্য মতে “গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ১২ এপ্রিল চিঠি দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে। ২১ এপ্রিল পর্যন্ত সেই চিঠির জবাব দেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২২ এপ্রিল সকাল ১০ থেকে বিকাল সাড়ে ৪ টা পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের একজন কর্মীকে বসিয়ে রেখেছিলেন। তারপর বলেছেন, আমার কাছে ফাইল নেই-খুঁজে পাচ্ছি না। আজ চলে যান।
এই দিকে বাংলাদেশে একটি সংবাদ পত্রে দেখলাম, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডক্টর বিজন কুমার শীল উদ্ভাবিত টেস্টিং কিট ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট’ এর নমুনা হস্তান্তর অনুষ্ঠানে সরকারের প্রতিনিধিরা যাননি। তবে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) প্রতিনিধির কাছে কিটের নমুনা তুলে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “কাল হঠাৎ আমাদেরকে ঔষধ প্রশাসনের উনারা জানালো যে, উনার আজকে আসতে পারবেন না। বিএমআরসির চেয়ারম্যান সাহেবকে অনুরোধ করেছিলাম, উনি ফোন করে আমাকে জানিয়েছেন উনি অসুস্থ আসতে পারবেন না। আমরা আর্মি প্যাথলজি ল্যাবরেটরিকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, অনুমতি পাননি বলে আসতে পারবেন না বলে জানিয়েছে।
“আজকে শুধু আমেরিকার সিডিসির প্রতিনিধি এসেছেন। এই হলো বাংলাদেশে সরকারি সাহায্যের নমুনা। অথচ বাংলাদেশে বর্তমানে করোনা ভাইরাস মারাত্মক আকার ধারণ করছে। এই ধরণের সস্তা ঠিক দেশের মানুষের জন্য খুবই জরুরি. এটি বাজার জাত হলে অনেক মানুষ বাঁচবে। শুধু দরকার সরকারি সহযোগিতা।
কানাডার Spartan Bioscience কোম্পানি করোনা ভাইরাস পরীক্ষার যন্ত্র আবিষ্কারের কথা বলে যা আকারে বড় কফি মগের সমান (hand-held DNA analyzer) ও মাত্র ১৫ মিনিটে রেজাল্ট দেয়। সেই আবিষ্কারের কথা বলার পরের দিনই সরকার সেই কোম্পানিকে সকল প্রকার সাহায্য (আর্থিক ও প্রশাসনিক) দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বাজারে আসার ব্যবস্থা করল যদিও শুরু তেই কানাডা সরকারের কাছে প্রায় ১০ লক্ষ করোনা পরীক্ষার কীট ছিল।
কয়েকদিন আগে সারাহ গিলবার্টের একটি ইন্টারভিউ সম্পর্কে লিখেছিলাম। সেখানে তিনি অনেক কথা বলেছেন,
অক্সফোর্ড বিশ্ব বিদ্যালয়ের এই প্রফেসর সারা গিলবার্ট ইতোমধ্যে এই টিকা আবিষ্কার করে ফেলেছেন। মানুষের উপর তার আবিষ্কৃত টিকার ট্রায়াল শুরু হয়েছে গত শুক্রবার। তিনি শতকরা ৮০ ভাগ সাফল্যের আশাবাদী। ব্রিটিশ সরকার ইতিমধ্যে শুধুমাত্র সারার প্রকল্পে ২২ মিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্ধ করেছে। বলেছে প্রয়োজনে আরও বরাদ্ধ করবে. সরকার প্রয়োজনে মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্ধ করতে রাজি। প্রফেসর গিলবার্ট বলেন তিনি এবং তার টিম ৭ দিন দিনে রাতে কাজ করে যাচ্ছেন এই টিকা আবিষ্কারে। এই প্রথমবার টিকা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলেন বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যরকমের সহযোগিতা। ক্লিনিক্যাল ট্র্যায়েলের জন্য ৫’শ লোক দরকার। সবকিছু ঠিক থাকলে September এ এই টিকা বাজারজাতকরণ সম্ভব। এই বিজ্ঞানী সারাহ কখনো কোন কিছু বাড়িয়ে বলেন না বলে সাংবাদিকরা জানিয়েছেন।
তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির valccinilogy ‘র প্রফেসর। সাধারণত ভ্যাকসিন বের করতে কয়েক বছরের ট্রায়াল লাগে। বাজার জাত করতে ও অনেক অনেক সময় লাগে। কিন্তু কোবিড ১৯ এর জন্য ব্যাপক ভাবে কাজ হচ্ছে। এবং বেশ কিছু কাজ এক সঙ্গে করা হচ্ছে যা সাধারণত পর্যায়ক্রমে করা হয়। টিকা আবিষ্কারের কয়েকটি ধাপ রয়েছে। প্রথমটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অপেক্ষা কৃত তরুণদের নিয়ে ট্রায়াল দ্বিতীয় ধাপ বয়সসীমা ৫৫ থেকে ৭০। প্রথম ধাপ হচ্ছে প্রস্তুতকারক ক্লিনিকাল ট্রায়াল করবে যা হবে নিয়ন্ত্রিত এবং সার্টিফাইড। সারাহ গিলবার্টের টিম চাচ্ছে সারা বিশ্বের রেগুলেটররা এক যুগে ক্লিনিকাল ট্রায়াল চালাবে। সারাহ গিলবার্ট বলেন ব্রিটেনের রেগুলেটর তাদের সঙ্গে কাজ করছে। তার আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনটি ইমার্জেন্সি রেগুলেশনের অধীনে লাইসেন্স করা হবে কারণ এটা জরুরি পরিস্থিতিতে তৈরী করা হয়েছে। তিনি বলেন এটা ব্যাপক আকারে এবং দ্রুত করা উচিত।
প্রফেসর সারাহ গিলবার্ট চান সরকার এই ভ্যাকসিন তৈরিতে ব্যাপক অর্থ ব্যায় করুক। তিনি প্রাথমিক ভাবে ৫০ থেকে ১’শ মিলিয়ন পাউন্ড সরকারি বরাদ্ধ চান, যা দিয়ে ভ্যাকসিন তৈরী করা যায়। ইউকে তে সফল হলে এটা বিশ্ব ব্যাপী করা যেতে পারে। প্রফেসর সারাহ বলেন আমরা চাই সকলেই এই ভ্যাকসিন ব্যবহারে উপকৃত হউক। প্রফেসর সারাহ বলেন আমি একটা কলে ছিলাম যেখানে কমপক্ষে ৩০ টা ভিন্ন এপ্রোচ দেখানো হয়েছে। তিনি বলেন , যত শীঘ্র জানব আমাদের জন্য ভ্যাকসিনটা কাজ করছে এবং কিভাবে কাজ করছে, সর্বোপরি কি পরিমান রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা অর্জন করেছে তখন ই আমরাএকে সকলের জন্য বাজারজাত করব। প্রফেসর সারাহ গিলবার্ট বলেন তার ক্লিনিক বর্তমানে এই ভ্যাকসিন পরীক্ষা করার জন্য ভলান্টিয়ার যাচাই বাছাই করছে।
অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী বিজন কুমার শীল আমাদের গর্ব। আমাদের গুণীজন। তাকে অশেষ শ্রদ্ধা জানাই। শ্রদ্ধা জানাই তাঁর সহযোদ্ধাদের। একই সঙ্গে দেশ ও জাতির প্রয়োজনে ডক্টর শীলের উদ্ভাবিত করোনা ভাইরাস কীট বাজার জাত করণে সরকারি সহযোগিতা অপরিহার্য্য। আজ আর না। খোদা হাফেজ
লেখক: তারেক চৌধুরী, সেভেন কিংস, রেডব্রিজ ইউনাইটেড কিংডম।